“তোমাদের বাবা তোমাদের অন্য এক মায়ের টানে চলে গেছে, সে মায়ের নাম বাংলাদেশ”

শেখ মেহেদী হাসান নাদিম
পৃথিবীতে এমন দুর্ভাগ্য আর কোনো পরিবারের ঘটেছে কিনা জানা নেই—কারণ, যে শিশুটির জন্মে মাতৃভূমি পেল এক বীরশ্রেষ্ঠ সন্তান, পক্ষান্তরে তাঁর পরিবার পেলো সর্ব নিকৃষ্ট ঘৃণার জঘন্য বেদনা। বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের নিয়ন্ত্রণ হারানো যুদ্ধবিমানের আঘাত যেন শুরু হয়েছিল তাঁর মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানের হৃদয়ে। সেই আঘাতের রক্তক্ষরণ শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বেদনার বিষ ঢেলে দিয়েছিল তাঁদের জীবনে, যা দেশপ্রেমের বিপরীতে এনেছিল এক অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় পুরস্কার — আমৃত্যু সাজা।
পুরোনো ঢাকার এক সাধারণ বাঙালি পরিবারে জন্ম নেওয়া এগারো ভাই-বোনের মধ্যে ষষ্ঠ ছিলেন তিনি। বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ এবং মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। মেট্রিক পাশের পর তাঁর স্বপ্ন তাঁকে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। ১৯৬১ সালে বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে দীর্ঘ দশ বছর তিনি নিষ্ঠার সাথে অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছিল সুউচ্চ পদমর্যাদা, সরকারি আবাসনের নিরাপত্তা এবং সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে বিশেষ সম্মান। স্ত্রী মিলি, দুই কন্যা মাহিন ও তুহিনকে নিয়ে তাঁর সংসার ছিল সুখের আধার।
সামরিক নিরাপত্তার ঊর্ধ্বে দেশপ্রেমের আহ্বান
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বার্ষিক ছুটিতে ঢাকায় এসে তিনি সচক্ষে দেখেন বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরম বৈষম্য। ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যা শুরু হওয়ার পর তাঁর ভেতরের বাঙালি আত্মা জেগে ওঠে। সামরিক জীবনের সমস্ত নিরাপত্তা তুচ্ছ করে তিনি গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রামনগরে ছুটে যান। সেখানে তিনি স্থানীয় যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। এটিই ছিল শতভাগ দেশপ্রেমীর জীবনের প্রথম কঠিন পরীক্ষা।
দেশ স্বাধীন করার অদম্য জেদ তাঁকে আবার পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে বাধ্য করে। তিনি উপলব্ধি করেন, মুক্তিসেনাদের হাতে শত্রুর অস্ত্র তুলে দিতে হলে তাঁকে শত্রুর ঘাঁটিতেই ফিরতে হবে। সেখানে তিনি এক দুঃসাহসিক, প্রায় আত্মঘাতী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন—শত্রুর বিমান ছিনতাই করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করা।

চূড়ান্ত আত্মদান ও অপমানের গ্লানি
অবশেষে এলো সেই চরমতম ক্ষণ। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট, করাচির মাসরুর বিমান ঘাঁটিতে তিনি তাঁর সহকর্মী, পাঞ্জাবি পাইলট অফিসার রাশেদ মিনহাজের সাথে টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে উড্ডয়ন করেন। বিমান ছিনতাই করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে ককপিটের ভেতরে চরম সংঘাত শুরু হয়। এক পর্যায়ে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয় এবং তিনি শহীদ হন। তাঁর এই প্রচেষ্টা অপূর্ণ ছিল বটে, কিন্তু তাঁর অদম্য সাহস দেশপ্রেমের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
তবে নিয়তির শেষ নিষ্ঠুরতা বাকি ছিল। তাঁর জন্মদাতা পিতা-মাতার ভাগ্যে জুটল সেই সর্ব নিকৃষ্ট ঘৃণার জঘন্য বেদনা। তাঁরা জানতে পারলেন, তাঁদের সন্তানকে অন্য রাষ্ট্রের মাটিতে, সম্পূর্ণ অবজ্ঞা ও ঘৃণার সঙ্গে সমাহিত করা হয়েছে, এবং সেই কবরের ফলকে লেখা সেই মর্মান্তিক বাক্য: “ইধার শো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার” (এখানে একজন বিশ্বাসঘাতক শুয়ে আছে)।
পিতা-মাতার অন্তরের রক্তক্ষরণ ছিল চরম। দেশপ্রেমের মহত্তম ত্যাগের পুরস্কার হিসেবে তাঁরা সন্তানকে পেলেন না, পেলেন কেবল ‘বিশ্বাসঘাতক’ নামের এক চরম গ্লানি। তাঁদের জীবনের বাকি দিনগুলো ছিল নীরবে সেই অপমানের বোঝা বয়ে চলা, যা ছিল দেশপ্রেমের বিপরীতে তাঁদের জন্য এক ভয়াবহ পুরস্কার। নিজ সন্তানের মৃতদেহ একবার নিজ হাতে ছুঁয়ে দেখার শেষ আকাঙ্ক্ষাটুকুও অপূর্ণ রেখে তাঁরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

স্ত্রীর কাছে মতিউর রহমানের শেষ চিঠি
তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মিলি, দুই শিশু কন্যা মাহিন ও তুহিন—তাঁদের জীবনও লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। তাঁর শেষ চিঠিটি যেন সেই পরিবারের জন্য শেষ উপহার এবং শোকের এক মহাকাব্য:
প্রিয়তমা মিলি,
একটা চুমু তোমার পাওনা রয়ে গেল। সকালে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তোমাকে চুমু না খেয়ে বেরুলে আমার দিন ভালো যায় না। আজ তোমাকে চুমু খাওয়া হয়নি। আজকের দিনটা কেমন যাবে, জানি না।
এই চিঠি যখন তুমি পড়ছো, আমি তখন তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। ঠিক কতটা দূরে, আমি জানি না।এই চিঠি যখন তুমি পড়ছো, আমি তখন তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। ঠিক কতটা দূরে, আমি জানি না।
মিলি, তোমার কি আমাদের বাসর রাতের কথা মনে আছে? কিছুই বুঝে ওঠার আগে বিয়েটা হয়ে গেল। বাসর রাতে, তুমি যখন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছ, আমি তখন তোমার হাতে একটি কাঠের বক্স দিলাম। তুমি খুললে, সাথে সাথে বক্স থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি বেরিয়ে সারা ঘরময় ছড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, আমাদের ঘরটা একটা আকাশ, আর জোনাকিরাই তারার ফুল ফুটিয়ে এসেছে। কান্না থামিয়ে তুমি অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, “আপনি এত পাগল কেন?”মিলি, আমি আসলেই পাগল, নইলে তোমাদের এভাবে রেখে যেতে পারতাম না।
মিলি, আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন— প্রিয় কন্যা মাহিনের জন্মের দিনটা। তুমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলে আর বাইরে আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি। আমি সেই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রসবের তিথিতে তোমার কষ্টের পুড়ে যাচ্ছি। অনেকক্ষণ পর, প্রিয় কন্যার আরোদ্ধ্য কান্নার শব্দ। আমার হাতের মুঠোয় প্রিয় কন্যার হাত। এরপর আমাদের সংসারে এলো আর একটি ছোট্ট পরি, তুহিন।মিলি, তুমি কি জানো, আমি যখন আমার প্রিয় কলিজার টুকরো দুই কন্যাকে একসাথে দোলনায় দোল খেতে দেখি, আমার সমস্ত কষ্ট, সমস্ত যন্ত্রণা ধুয়ে যায়। তুমি কি কখনো খেয়াল করেছো? আমার দুই কন্যার শরীরে আমার শরীরের সুক্ষ একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়?
মিলি, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার কন্যারা যদি কখনো জিজ্ঞেস করে, “বাবা কেন আমাদের ফেলে চলে গেছে?”, তুমি তাদের বলবে, “তোমাদের বাবা তোমাদের অন্য এক মায়ের টানে চলে গেছে। যে মাকে তোমরা কখনো দেখোনি, সে মায়ের নাম বাংলাদেশ।”মিলি, আমি দেশের ডাক উপেক্ষা করতে পারিনি। আমি দেশের টানে ছুটে না গেলে আমার মানবজন্মের নামই সত্যি কলঙ্ক হবে। আমি তোমাদের যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি আমাকে জন্ম দেওয়া এই দেশটাকে।
যে দেশের প্রতিটি ধূলিকণা আমার চেনা, আমি জানি সে দেশের নদীর স্রোত কেমন। এই দেশটাকে হানাদারেরা গিলে খাবে—এটা আমি কী করে মেনে নেই? আমার মায়ের আঁচল শত্রুরা ছিঁড়ে নেবে—এটা আমি সহ্য করি কিভাবে মিলি?
আমি আবার ফিরব, মিলি। আমাদের স্বাধীন দেশের পতাকা বুকপকেটে নিয়ে ফিরব। তুমি, আমি, মাহিন ও তুহিন—বিজয়ের দিনে স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়াবো সবাই।তোমাদের ছেড়ে যেতে বুকের বাঁ পাশে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। আমার মানিব্যাগে আমাদের পরিবারের ছবিটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। বেশি কষ্ট হলে খুলে দেখব। ভালো থেকো মিলি, ফের দেখা হবে। আমার দুই চোখের মণিককে অনেক অনেক আদর।
ইতি, মতিউর
সেই প্রেমিকের ‘ফের দেখা হবে’ প্রতিশ্রুতি আর কোনোদিন পূরণ হয়নি। এই হলো শতভাগ দেশপ্রেমীর রেখে যাওয়া চূড়ান্ত উত্তরাধিকার—ব্যক্তিগত ক্ষতি আর পারিবারিক যন্ত্রণার এক মহাকাব্য।