শেষ হয়নি আর্থিক নির্মান :২০৫৬ সাল পর্যন্ত চলবে নাগরিকের ‘অদশ্য জরিমানা’

পদ্মা সেতু। ছবি: জাহান।
ওয়ালিদ আহমেদ অলি
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দুই বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে । প্রতিদিন হাজারো যানবাহন পারাপার হচ্ছে , দৈনিক টোল আদায় হচ্ছে কোটি টাকার উপরে । রাষ্ট্রীয় বর্ণনায় এটি আমাদের ‘গর্ব’ ও ‘সক্ষমতার প্রতীক’। কিন্তু এই দৃশ্যমান সফলতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য বাস্তবতা—সেতুটির নির্মাণকাজ এখনও শেষ হয়নি ।অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, সেতু দাঁড়িয়ে আছে , গাড়ি ও চলছে , তবে নির্মাণ কাজ চলছে কীভাবে ? বাস্তবতা হলো, সেতুর ভৌত নির্মাণ শেষ হলেও এর আর্থিক নির্মাণ—অর্থাৎ যে বিশাল ঋণের বোঝায় এটি তৈরি হয়েছে ,তার পরিশোধ—এখনও চলছে । আর সেই নির্মাণের খরচ জোগানো হচ্ছে সরাসরি আপনার, আমার, অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের পকেট থেকে । এটি এমন এক নির্মাণযজ্ঞ, যা চলবে আগামী ২০৫৬ সাল পর্যন্ত।
যেভাবে জনগণের পকেট থেকে টাকা যাচ্ছে
বিষয়টি কোনো জটিল অর্থনৈতিক তত্ত্ব নয়। প্রতিদিন আপনি যে মোবাইল ফোন রিচার্জ করছেন, বিদ্যুৎ বা পানির বিল দিচ্ছেন, কিংবা বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় যা-ই কিনছেন—তার প্রতিটি লেনদেনের সাথে আপনি নিজে ও অজান্তে পদ্মা সেতুর ‘অদৃশ্য নির্মাণকাজে’ অর্থ দিয়ে যাচ্ছেন।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের স্বল্প সুদের (মাত্র ১ শতাংশ) ঋণ ফিরিয়ে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের যে ‘রাজনৈতিক জেদ’ দেখানো হয়েছিল, তার আসল মূল্য শোধ করছে জনগণ। সেই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের আপামর জনসাধারণের ওপর চেপেছে এক দীর্ঘমেয়াদী পরোক্ষ করের বোঝা। একটি পরিবারের মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকা হলেও, বছরের পর বছর তাকে যে প্রায় ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ‘জরিমানা’ হিসেবে গুনতে হচ্ছে, সেই হিসাবটি কেউ রাখছে না।
এই অর্থকে ‘অদৃশ্য জরিমানা’ বলাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, রাষ্ট্র এই অর্থ কেটে নেওয়ার আগে আপনার অনুমতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি।
টোল আদায়ের টাকা তবে যাচ্ছে কোথায়?
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সেতু থেকে যে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি টোল আদায় হচ্ছে, সেই টাকা কোথায় যাচ্ছে? সেই টাকা দিয়ে কেন সেতুর ঋণ পরিশোধ না করে জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে?
এই প্রশ্নটিই গত এক যুগের বেশি সময় ধরে একা তুলে ধরেছেন সাংবাদিক শেখ মেহেদী হাসান নাদিম। ২০১১ সালে, যখন বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের ‘দুর্নীতির নাটক’ মঞ্চস্থ হচ্ছিল, তখনই তিনি এই ভয়াবহ পরিণতির কথা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই ভুলের মাশুল কোনো ধনী কর্পোরেশন বা রাজনীতিবিদকে দিতে হবে না, এর দায় চাপবে সাধারণ মানুষের কাঁধে।
সত্য বলার নির্মম পুরষ্কার
সেই আশঙ্কার কথা জানিয়ে, দেশের মানুষের পকেট বাঁচানোর জন্য শেখ নাদিম যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও সমমনাদের নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন, রাষ্ট্র তখন তার কণ্ঠরোধ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ‘নৌ এবং যোগাযোগ মন্ত্রীকে পদচ্যুত না করা হলে শহীদ মিনারে ঈদ’—এই শিরোনামে গড়ে ওঠা সেই প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল মূলত রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা বাঁচানোর এক আকুতি। সেই প্রতিবাদের পুরস্কার হিসেবে নাদিমের ওপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। একে একে সাতটি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয় তাঁর নামে, কেড়ে নেওয়া হয় সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা।
কিন্তু রাষ্ট্রের আক্রোশ তাতেও থামেনি। যখন তাঁর আর কিছুই কেড়ে নেওয়ার বাকি ছিল না, তখন চূড়ান্ত আঘাত হানা হয় তাঁর অস্তিত্বের ওপর। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বাতিল করে শেখ নাদিমের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া, তাঁর বাবা মরহুম হাবিবুর রহমান শেখের হাতে গড়া অর্ধশত বছরের পুরনো ‘দৈনিক জাহান’ পত্রিকার লাইসেন্স। যে কলমটি জনগণের পক্ষে সত্য লিখছিল, রাষ্ট্র সেই কলমটিকেই ভেঙে দেয়।
নির্মাণ চলবে ২০৫৬ সাল পর্যন্ত
শেখ নাদিমের কলম ভেঙে দিলেও তাঁর তোলা প্রশ্নটি আজও জীবন্ত। পত্রিকার লাইসেন্স বাতিল হওয়ার পরও তিনি অনলাইনে একাই লিখে চলেছেন: “সেতু নির্মাণ শেষ ২২ সালে, দৈনিক কোটির উপর উঠে টোল, তা থেকে পরিশোধ না করে বিনা অনুমতিতে জনগণের উপর পরোক্ষ কর আর কত নেবে সরকার?”
আজ পদ্মা সেতু দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই সেতুর প্রতিটি ইটের নিচে চাপা পড়ে আছে শেখ নাদিমের মতো সত্য বলা মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর জনগণের নীরব রক্তক্ষরণ। যতদিন পর্যন্ত এই ‘অদৃশ্য ঋণ’ শোধ না হচ্ছে, যতদিন পর্যন্ত প্রতিটি মোবাইল রিচার্জের টাকায় আপনি এই ঋণের কিস্তি দিচ্ছেন—ততদিন পর্যন্ত গর্বের এই সেতুর নির্মাণকাজ চলতেই থাকবে।
আপনার, আমার টাকায়, ২০৫৬ সাল পর্যন্ত।
