আল–জাজিরা

নেপালের কাঠমান্ডুতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও কারফিউ চলাকালে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে মুঠোফোনে ছবি তুলছেন আন্দোলনকারীরা। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, নেপালছবি: রয়টার্স
নয়াদিল্লি
আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ১৫
লোহার ফটক ভেঙে বিক্ষুব্ধ লোকজন যখন দৌড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করল, তখন চারপাশ কেঁপে উঠল। কয়েক ঘণ্টা আগেও যা ছিল ক্ষমতার প্রতীক, মুহূর্তেই তা গুঁড়িয়ে দিল জনতার ঢল। প্রধানমন্ত্রীদের বাসভবনের করিডর ভরে গেল কাদামাখা পায়ে হাঁটার শব্দে। কেউ জানালার কাচ ভাঙলেন, কেউ আবার দামি চাদর আর জুতা নিয়ে গেলেন। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা যে বাড়ি এত দিন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল, সেদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁরাই তা দখলে নিলেন। এই দৃশ্য শুধু নেপালের গত সপ্তাহের নয়, এটি শ্রীলঙ্কার ২০২২ সালের এবং বাংলাদেশের ২০২৪ সালেরও চিত্র।
কেন দক্ষিণ এশিয়া জেন–জি বিপ্লবের কেন্দ্র?
৩০ মিলিয়ন মানুষের দেশ নেপালের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ প্রথাগত নির্বাচনী গণতন্ত্রের চেনা ধারা ভেঙে দিয়েছে। এর ফলে, দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোয় একের পর এক সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ প্রজন্ম বিশ্বকে নতুন এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে—দক্ষিণ এশিয়াই কি জেন–জি (জেনারেশন জেড) প্রজন্মের বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল?
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ড আল-জাজিরাকে বলেন, “এটা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। এখানে একধরনের নতুন অস্থির রাজনীতির জন্ম হচ্ছে।” তিনি মনে করেন, এই ধরনের আন্দোলন সামরিক অভ্যুত্থান থেকে ভিন্ন এবং এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক নাটকীয় পরিবর্তন।
নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপট
এই তিনটি দেশের আন্দোলনের পেছনে তাদের নিজস্ব ইতিহাস ও অনন্য প্রেক্ষাপট আছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মধ্যে কিছু মিলও রয়েছে—নতুন প্রজন্ম আর ভাঙা প্রতিশ্রুতি মেনে নিচ্ছে না। এছাড়াও, এই আন্দোলনগুলো একে অপরের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।
- নেপাল: নেপালের সাম্প্রতিক জেন-জি আন্দোলনের সূত্রপাত সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত থেকে। তবে, ক্ষোভের প্রকৃত কারণ ছিল বৈষম্য, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি। প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি জেন-জি প্রজন্মকে উপহাস করার কয়েক দিনের মধ্যেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। এরপর ডিসকর্ড প্ল্যাটফর্মে ভোট দিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়।
- বাংলাদেশ: ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হলেও, পুলিশি দমন-পীড়নের পর তা শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়। অবশেষে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতে পালিয়ে যান।
- শ্রীলঙ্কা: ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পতন থেকে এই আন্দোলনের জন্ম হয়। দেশটির মুদ্রা ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাবে জনজীবন হয়ে উঠেছিল দুঃসহ। এই আন্দোলন ‘আরাগালায়া’ বা ‘সংগ্রাম’ নামে পরিচিতি পায়, যার ফলে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে প্রেসিডেনশিয়াল সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভকারীদের যাওয়া ঠেকাতে সড়ক অবরোধ করে পুলিশের বিশেষ টাস্কফোর্স
ফাইল ছবি: এএফপি
দুই প্রজন্মের মতের ফারাক
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়ার উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি মনে করেন, এই তিন দেশের আন্দোলনের মূল কারণ এক—বৈষম্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি। এই রাজনৈতিক নেতারা তরুণ প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের জন্য এসব রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিজেদের মতের মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।”
এই নেতাদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেদের জীবনযাত্রার মানের বিশাল ব্যবধান তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে তরুণরা বিচ্ছিন্ন জীবন কাটালেও, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তাদের সংযোগ এবং সচেতনতা অভাবনীয় মাত্রায় বেড়ে যায়, যা এই বিপ্লবের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। আরও পড়ুন (
আল-জাজিরার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের লিঙ্ক হলো: