সাংবাদিক, শিল্পপতি ও শিক্ষানুরাগী

শেখ হাবিবুর রহমান। ছবি: শেখ নাদিম।
মরহুম হাবিবুর রহমান শেখ ছিলেন একজন প্রথিতযশা বাংলাদেশী সাংবাদিক, জাতীয় পর্যায়ের শিল্প উদ্যোক্তা, রাজনৈতিক সংগঠক, শিক্ষাবিদ এবং সমাজসেবক। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সংগ্রামে, দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সংগঠনে এবং ময়মনসিংহের শিক্ষাখাতে অসামান্য অবদানের জন্য স্মরনীয় হয়ে আছেন।
প্রারম্ভিক জীবন ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা (১৯৬৬-১৯৭১)
হাবিবুর রহমান শেখের কর্মময় জীবনের সূচনা ঘটে ছাত্র রাজনীতি এবং গণমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
- ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬): তিনি ‘৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন।
- গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯): ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ময়মনসিংহে ‘বাকসু’র (BAKSU) ভিপি হিসেবে একক নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং ১১ দফা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
- মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১): বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি একজন ‘নেপথ্য সংগঠক’ হিসেবে অসামান্য অবদান রাখেন।
সাংবাদিকতার সংগ্রাম ও বাকশাল (১৯৭৫)
হাবিবুর রহমান শেখের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী অধ্যায়টি ছিল ১৯৭৫ সালে, যখন তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মুখে দাঁড়িয়ে নিজের আদর্শ ও সংবাদপত্রের নীতিতে অটল ছিলেন।
- বাকশাল সনদে অস্বীকৃতি: ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে যখন তৎকালীন সরকার একদলীয় ‘বাকশাল’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং দেশের প্রায় সকলকেই এই সনদে স্বাক্ষর করতে বলা হয়।হাবিবুর রহমান শেখকে ঢাকায় ডেকে পাঠানো স্বত্ত্বেও তিনি ছিলেন সেই হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম, যিনি সাহসিকতার সাথে বাকশাল সনদে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।
- সংবাদ পরিবেশনে সততা ও নিরপেক্ষতা: ৮ই মার্চ, ১৯৭৫-এ যখন দেশের প্রায় সমস্ত সংবাদপত্র শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল ব্যবস্থার প্রশংসায় সংবাদ পরিবেশন করছিল, হাবিবুর রহমান শেখ সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না।শুধু তাই নয় তিনি তাঁর তৎকালীন পত্রিকা ‘বাংলার দর্পণ’-এ সেই রাষ্ট্রীয় প্রচারণামূলক সংবাদ প্রকাশ করা থেকেও সম্পূর্ণ বিরত থাকেন।
- সংবাদপত্রের কালো দিবস’ : এই সাহসী ভূমিকার পরিণতিতে, ১৯৭৫ সালের ১৬ই জুন, সরকার যখন অন্য সব পত্রিকার সাথে তাঁর পত্রিকাও বন্ধ করে দেয়, তখন তিনিই প্রথম এই দিনটিকে “সংবাদপত্রের কালো দিবস” হিসেবে নামকরণ করেন।
শিল্প, বাণিজ্য ও সাংবাদিকতায় নেতৃত্ব
‘দৈনিক জাহান’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি, হাবিবুর রহমান শেখ জাতীয় পর্যায়ে শিল্প ও সাংবাদিকতার বিভিন্ন সংগঠনের মূল নেতৃত্বে আসীন ছিলেন।
শিল্প ও বাণিজ্যে
- ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়ন: তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (BSCIC) প্রতি গভীর মনোনিবেশ করেন এবং এর বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
- কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব: তিনি ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ স্মল এন্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ’ (NASCIB)-এর ১৯৮৪ সাল থেকে টানা ৭ বার নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সিআইপি: বাণিজ্যিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে তিনি ২৫টিরও অধিক দেশ ভ্রমণ করেন। দেশের শিল্প ও বাণিজ্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, তিনি ১৯৯১ সালে সিআইপি (Commercially Important Person) হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা লাভ করেন।
সাংবাদিকতায়
- ‘দৈনিক জাহান’ প্রতিষ্ঠা (১৯৮০): তিনি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা কীর্তি, ‘দৈনিক জাহান’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন।
- সম্পাদকীয় নেতৃত্বে: তিনি বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ৬ বছর সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৭ বার নির্বাচিত সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব: ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি বহুবার নির্বাচিত সহ-সভাপতি হিসেবে সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দেন।
শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় সম্মান
তাঁর কর্মপরিধি কেবল শিল্প ও সাংবাদিকতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতেও তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
- একাডেমিক স্বীকৃতি: তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।
- বিচারিক দায়িত্ব: তাঁর নিষ্ঠাবান ও বিচক্ষণ চরিত্রের সম্মানে, তাঁকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেস কাউন্সিলের গণমাধ্যম-সম্পর্কিত বিচারিক কমিটির উচ্চ মর্যাদার সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।
- শিক্ষায় অবদান: ময়মনসিংহের শিক্ষা খাতে তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে শত শত কোটি টাকার ভূ-সম্পত্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য দান করে গিয়েছেন, যা ওই অঞ্চলে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
- রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি : ২০১২ সালের ২৬ মার্চ তাঁর মৃত্যুর সময়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকারে থাকা সত্ত্বেও, দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি উভয়েই তাঁকে “বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক” হিসেবে উল্লেখ করে আনুষ্ঠানিক শোক বিবৃতি প্রদান করেন, যা তাঁর দলমত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মানের প্রমাণ বহন করে।
হাবিবুর রহমান শেখের জীবন ছিল আদর্শ, সততা, দেশপ্রেম, শিল্পোদ্যোগ এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রামের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি।
