
তৈরি পোশাকশিল্প খাতছবি:
শুভংকর কর্মকার
ঢাকা
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ০০
শ্রম আইন সংশোধন করে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আরও সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগে। সংশোধিত আইনে ‘শতাংশ’ আর থাকছে না। ন্যূনতম ২০ জন শ্রমিকের সায় থাকলেই ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে, এমন বিধান যুক্ত হচ্ছে। মালিকপক্ষ অবশ্য এর বিরোধিতা করছে। শ্রমিকনেতাদের একটি অংশেরও দ্বিমত রয়েছে, যদিও তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলছেন না।
ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের নতুন উদ্যোগটি যথাযথভাবে করা না গেলে শিল্পকারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন শ্রমিকনেতাদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, ২০ জনের সম্মতির সুযোগ নিয়ে মালিকপক্ষ, রাজনৈতিক দল কিংবা যেকোনো পক্ষ অসৎ উৎসাহে কারখানা পর্যায়ে ইউনিয়ন করে ফেলতে পারবে। এতে দর–কষাকষি করে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জায়গাটি আরও দুর্বল হয়ে যাবে।
মালিকপক্ষ প্রস্তাবিত বিধানটির বিরোধিতা করে বলছে, ২০ জন শ্রমিক নিয়ে গঠিত হলে তা ট্রেড ইউনিয়নকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে কারখানায় বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর
শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সহজ করতে এবং শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধনে শ্রম আইন সংস্কারের চাপ আছে। দীর্ঘদিন ধরে এ চাপ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। সে অনুযায়ী ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার শ্রম আইন সংশোধনে একটি রূপকল্প ঘোষণা করে, যা অন্তর্বর্তী সরকার এগিয়ে নিচ্ছে। তারা গত মার্চে শ্রম আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করে আইএলওর গভর্নিং বডির বৈঠকে উপস্থাপন করেছে। পরে শ্রম মন্ত্রণালয় জানায়, আইনের ১০১টি ধারা-উপধারা সংশোধন করা হবে।
পরবর্তী সময়ে শ্রম কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আরও কিছু বিষয়ে সংযোজন-বিয়োজন করে সরকার। গত ২৬ আগস্ট ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) ৮৯তম বৈঠকে খসড়া নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা হয়। টিসিসিতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক—তিন পক্ষে ২০ জন করে সদস্য রয়েছেন।
টিসিসির সভায় উত্থাপিত সংশোধনী অনুযায়ী, একটি প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম ২০ জন শ্রমিকের সম্মতি থাকলেই ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে। তবে একটি প্রতিষ্ঠানে পাঁচটির বেশি ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন তখনই যৌথ দর–কষাকষির প্রতিনিধি (সিবিএ) বলে গণ্য হবে, যদি তারা গোপন ব্যালটে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পায়।
বাংলাদেশে একসময় ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন লাগত। বর্তমানে লাগে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি। একটি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ তিনটি ইউনিয়ন করা যায়। তবে নিবন্ধন পেলেই একটি ইউনিয়নের নেতারা মালিকের সঙ্গে যৌথ দর-কষাকষি করতে পারেন।
টিসিসির সদস্য হিসেবে আছেন এমন কয়েকজন শ্রমিকনেতা জানান, ২০ জনে ট্রেড ইউনিয়ন করার বিষয়ে টিসিসির সভায় তাঁরা একমত পোষণ করেন। যদিও আগে শ্রমিকনেতাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মতৈক্য হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে শ্রমিকনেতা বাবুল আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন সহজ করতে হলে শ্রম অধিদপ্তরের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া ইউনিয়ন করলে শ্রমিকের চাকরি যাবে না, এটি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে শ্রমিকদের দর-কষাকষির জায়গাটি শক্তিশালী হবে। তিনি আরও বলেন, ‘২০ জনের সম্মতিতে ইউনিয়ন গঠনে বাধা নেই। তবে নিবন্ধন ও নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, এটি নিয়ে যেন আমরা জটিলতার মধ্যে না পড়ে যাই। তাহলে শ্রমিকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পুরো প্রক্রিয়া ঠিকঠাকভাবে করা না গেলে সব জায়গা খারাপের দিকে যাবে।’
বিশৃঙ্খলার শঙ্কা কেন
বর্তমানে দেশে হাজার দশেক নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ১ হাজার ৪০০। এসব ইউনিয়নের অল্প কিছু সক্রিয়, অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়। আবার ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন নানা অজুহাতে বাতিল করা হয়। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন ঠেকাতে মালিকপক্ষ নিজেদের পছন্দের লোকজন দিয়ে ইউনিয়নের নিবন্ধন নিয়ে নেয়। তাই ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন ও চর্চার জায়গাটি দুর্বল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শ্রমিকনেতা বলেন, ২০ জনের সম্মতিতে ইউনিয়নের সম্মতি দিলে এক সপ্তাহের মধ্যে শত শত প্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন নিবন্ধন হবে। এই সুযোগে শ্রমিকদের পাশাপাশি মালিকপক্ষ, রাজনৈতিক দল কিংবা কোনো বিশেষ গোষ্ঠী ইউনিয়ন করে ফেলবে। তা কেউ ঠেকাতে পারবে না। অর্থাৎ প্রকৃত শ্রমিকেরা আর ইউনিয়ন করার সুযোগ পাবেন না। অন্যদিকে ইউনিয়ন গঠনের পর সিবিএ নির্বাচন করতে হবে। এত সিবিএ নির্বাচন কিংবা তদারকি করার মতো ন্যূনতম সক্ষমতা শ্রম মন্ত্রণালয়ের নেই।
মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন (বিইএফ) গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, শিল্প খাতের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে প্রস্তাবটি দেওয়া হয়েছে। এতে শিল্পের বাইরের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কর্মক্ষেত্রের স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কম্বোডিয়ায় পাঁচটি ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ ছিল। সে কারণে দেশটির কারখানায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। জোর করে আমাদেরও কম্বোডিয়া বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘টিসিসিতে ইতিপূর্বে শ্রমিকেরা ১০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতিতে ইউনিয়ন করার দাবি করছিলেন। আমরা ১৫ শতাংশ করার পক্ষে ছিলাম। হঠাৎ করে ২০ জনের সম্মতিতে নিবন্ধনের বিষয়টি কোথা থেকে এল, তা বোধগম্য নয়। আমরা টিসিসির বৈঠকে এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিয়েছি।’
শ্রম সংস্কার কমিশন ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের অনুপাতের শর্তের পরিবর্তে ন্যূনতম শ্রমিকসংখ্যা বিবেচনা করার ওপর জোর দিয়েছিল। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে স্বচ্ছতা আনতে কমিশন বলেছে, শ্রম অধিদপ্তরকে ৫৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময়মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্যও শ্রম অধিদপ্তরকে জবা