
মো: শহিদুল ইসলাম
আপনার অনুমতি ছাড়াই টাকা নিচ্ছে যেভাবে
প্রতিদিন যখন বাজার করা হয়, যা কিছুই কেনা হয়, মোবাইল রিচার্জ করা হয়, গাড়ির তেল কিংবা বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হয়, তখন কি কেউ খেয়াল করেন যে, এই টাকার একটি অংশ অদৃশ্য ‘জরিমানা’ হিসেবে কেটে নেওয়া হচ্ছে?
এটি কোনো জটিল অর্থনীতির হিসাব নয়; এটি এই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মানিব্যাগের গল্প। তাদের অনুমতি ছাড়াই কেটে নেওয়া অর্থের গল্প। “পদ্মা সেতু নির্মাণ” সক্ষমতার নামে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আজীবন জরিমানা দেওয়ার গল্প!
উদাহরণস্বরূপ, একটি পরিবারের মাসিক আয় যদি ৫০ হাজার টাকা হয়, তবে সেই পরিবারের কর্তা হয়তো জানেনই না যে, তার অজান্তেই প্রতি বছর এই অদৃশ্য করের নামে তার পকেট থেকে প্রায় ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়ে যাচ্ছে। এই বোঝা ধনী বা বড় কর্পোরেশনগুলো বহন করে না; এই বোঝা বহন করতে বাধ্য হয় সাধারণ মানুষ, যারা প্রতিদিনের ছোট ছোট লেনদেন করের জালে আটকা পড়েন।
সক্ষমতার নামে আজীবনের জরিমানার গল্প
এই বাধ্যতামূলক জরিমানার গল্প শুরু হয়েছিল পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সেতুটি মূল সমস্যা নয়; মূল সমস্যা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেদ ও একটি ‘দুর্নীতির নাটক’। সেই নাটকের আর্থিক মাশুল হিসেবেই আজ দেশের জনগণের কাঁধে চেপেছে এক দীর্ঘমেয়াদী জরিমানার বোঝা, যা আগামী ২০৫৬ সাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হবে।
আর এই ভয়ঙ্কর জরিমানা রোধ করতেই, সেই ‘দুর্নীতির নাটক’টি থামানোর জন্য একাই লড়েছিলেন এক সাংবাদিক। তার নাম শেখ মেহেদী হাসান নাদিম।
সত্য বলার নির্মম পুরষ্কার
এই অদৃশ্য রক্তক্ষরণ তখন এক গভীর ব্যক্তিগত যন্ত্রণায় রূপ নেয়, যখন নাদিমের গল্পটি সামনে আসে। একজন ঘনিষ্ঠ হিসেবে নয়, এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে যখন তার প্রতি রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর আচরণ দেখি, তখন নিজের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়—সত্য বলার পুরস্কার কি এতই নির্মম?
২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক যখন ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের ঘোষণা বাতিল করে, তার প্রায় ৮ মাস পূর্বেই নাদিম এই পরিণতি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর জেদের কারণে এই স্বল্প সুদের (১ শতাংশ) ঋণটি হাতছাড়া হলে দেশের মানুষের ঘাড়ে কী ভয়ঙ্কর এক ঋণের বোঝা চাপবে।
শহীদ মিনারে ঈদ
সেই আঁধারের বিরুদ্ধে একটি প্রদীপ জ্বালানোর দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী আর হাতেগোনা ক’জন সমমনা সাংবাদিককে নিয়ে তিনি রাজপথে নেমেছিলেন। তার অনলাইন আন্দোলনের শিরোনাম ছিল: ‘নৌ এবং যোগাযোগ মন্ত্রীকে পদচ্যুত না করা হলে শহীদ মিনারে ঈদ’। সেই প্রতিবাদকে জোরালো করতে, সেই বিপদের ঘণ্টা বাজাতে, নাদিমেরা একটি ঈদও উদযাপন করেছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের শীতল বেদীতে।
রাষ্ট্র তার সন্তানের এই দূরদর্শিতাকে সহ্য করেনি। সেই প্রতিবাদের পুরস্কার কী পেলেন নাদিম? তার কণ্ঠরোধ করতে একে একে দেওয়া হলো সাতটি মিথ্যা মামলা। সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হলো। সেই দুঃসময়ে পাশে থাকা অধিকাংশই বাঁচার তাগিদে নিজেদের আড়াল করে নিলেন। তবুও তিনি থামেননি।

চিরতরে সাংবাদিকতার কন্ঠরোধ
আর সবশেষে, বর্তমান সরকারের আমলে, যখন তার আর কিছুই কেড়ে নেওয়ার বাকি ছিল না, তখন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন চূড়ান্ত আঘাত হানে। নাদিমের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া শেষ সম্বল, তার বাবার হাতে গড়া প্রায় অর্ধশত বছরের পুরনো “দৈনিক জাহান”—জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে রাষ্ট্রের তৃতীয় সেই পত্রিকাটির লাইসেন্স বাতিল করা হলো!
যে কলমটি নাদিম ধরেছিলেন জনগণের পকেট বাঁচানোর জন্য, যে কলমটি তিনি ধরেছিলেন রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা বাঁচানোর জন্য, সেই কলমটিকেই রাষ্ট্র ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল।
কিন্তু রাষ্ট্র কি ভেবেছিল কলম ভাঙলেই লেখা থেমে যাবে? নাদিম থামেননি। পত্রিকার লাইসেন্স কেড়ে নেওয়ার পরও, আজও তাকে দেখা যায় অনলাইনে একাই লিখে চলেছেন সেই একই প্রশ্ন: “সেতু নির্মাণ শেষ ২২ সালে, দৈনিক কোটির উপর উঠে টোল, তা থেকে পরিশোধ না করে বিনা অনুমতিতে জনগণের উপর পরোক্ষ কর আর কত নেবে সরকার”….
এই দেশ, এই জাতি, এই রাষ্ট্র—তার সন্তানের প্রতি কি এই ন্যায়বিচার করল?
যে মানুষটি চেয়েছিল দেশের মানুষের পকেট থেকে যেন অতিরিক্ত টাকা খসে না পড়ে, রাষ্ট্র উল্টো সেই মানুষটির পকেট শূন্য করে, তার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিল।
অদৃশ্য ঋনের বোঝা
আমরা জনগণ কী পেলাম? একটি সেতু আর তার সাথে ২০৫৬ সাল পর্যন্ত এক অন্তহীন ‘জরিমানা’। আর নাদিম? তিনি পেলেন হাফ ডজনের অধিক মানহানিকর মিথ্যা মামলা, বঞ্চনা, বাবার স্মৃতির ওপর চূড়ান্ত অপমান… আর সেই ভাঙা কলম নিয়েই একাকী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার এক অদম্য জেদ।
আজ পদ্মা সেতু দাঁড়িয়ে আছে। সেই সেতুর নিচে চাপা পড়ে আছে শেখ মেহেদী হাসান নাদিমের মতো সত্য বলা মানুষের দীর্ঘশ্বাস। আর সেই সেতুর ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে এক নীরব প্রশ্ন—দুর্নীতির নাটকের কারণে সৃষ্ট এই ‘অদৃশ্য ঋণ’ আর কতকাল বইতে হবে?
